ছাত্রী ধর্ষণ ও নির্যাতন
প্রতিবাদে, ক্ষোভে উত্তাল বগুড়া
ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছে বগুড়ার মানুষ। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শ্রমিক লীগ নেতা, নারী কাউন্সিলর এবং তাঁদের সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি উঠেছে। ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে মা-মেয়েকে নির্যাতন ও চুল কেটে দেওয়ার মামলার পলাতক পাঁচ আসামি তুফানের স্ত্রী আশা সরকার, কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তার ওরফে রুমকি, তাঁর মা রুমি বেগম, তুফানের দুই সহযোগী জিতু ও মুন্নাকে গতকাল রোববার ঢাকার সাভার ও পাবনা শহর থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ধর্ষণের শিকার মেয়েটি এখনো হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন মেয়েটি কাল সকালে জানিয়েছে, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। নড়াচড়া করতে পারছে না। মাথায় অনেক শখের চুল ছিল। চুলের কথা মনে হলেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান আবদুল মোত্তালেব হোসেন বলেন, মেয়েটির শরীরে লোহা বা রড-জাতীয় বস্তু দিয়ে সাত থেকে আট জায়গায় আঘাত করা হয়েছে। ফোলা ও জখম আছে।
গত শনিবার গ্রেপ্তার করা শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সামাদকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল সন্ধ্যায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তুফানের স্ত্রীর বড় বোন কাউন্সিলর মার্জিয়া ও তাঁর মাকে পাবনা মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে।
নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার জানান, তুফানের স্ত্রী আশা এবং দুই সহযোগী জিতু ও মুন্নাকে গতকাল রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ সাভারের হেমায়েতপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) খোরশেদ আলম বলেন, ওই তিন আসামি একটি প্রাইভেট কারে চড়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে বগুড়া থেকে রাজধানীর দিকে যাচ্ছিলেন। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সাভার থানার পুলিশ হেমায়েতপুরে তাঁদের আটক করে।
১৭ জুলাই বাড়ি থেকে ক্যাডার দিয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেন বগুড়া শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকার। ঘটনা ধামাচাপা দিতে দলীয় ক্যাডার এবং এক নারী কাউন্সিলরকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পেছনে লেলিয়ে দেন। গত শুক্রবার বিকেলে তাঁরা ওই কিশোরী ও তার মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে চার ঘণ্টা ধরে নির্যাতন চালান। এরপর দুজনেরই মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয় |
ক্ষুব্ধ বগুড়াবাসী
বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে বগুড়া শহরের সাতমাথায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদী গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও নারীবাদী বিভিন্ন সংগঠনসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন। কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ বজলুল করিম জমায়েতে বলেন, মেয়েটির ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, এটাকে শুধু মধ্যযুগীয় বর্বরতা বললে ভুল হবে। এটা চরম পৈশাচিকতা ও দানবীয়। দুষ্ট চক্রের দানবীয় শাসন-শোষণ থেকে নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় প্রতিবাদী হতে হবে, সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের জেলা সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা তুফান সরকারের মতো ধর্ষককে শুধু চমক দেখানোর জন্য গ্রেপ্তার করলে হবে না, বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, অতীতেও ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ‘আরেক সরকার’কে (তুফান সরকারের ভাই) গ্রেপ্তার করায় র্যাবের এক কর্মকর্তা রাতারাতি বদলি হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে দলটির বগুড়ার ‘আরেক পালোয়ান’কে গ্রেপ্তার করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।’ ক্ষমতাসীন দলের জেলা সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে তাঁর একাত্মতা ঘোষণা করা দরকার ছিল।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি সামির হোসেন প্রতিবাদ জমায়েতের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, ‘যে মেয়েটি এত দিন অন্য মানুষের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এই সাতমাথায় আমার সঙ্গে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকত, আজ তার ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে আমাদের ব্যানার হাতে এখানে দাঁড়াতে হয়েছে। এ কষ্ট প্রকাশের ভাষা জানা নেই। যারা এই নৃশংসতা চালিয়েছে, তারা এখনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায়। এমন নরপশু, দখলবাজ, চাঁদাবাজ, কুলাঙ্গারকে দল থেকে বহিষ্কার করুন।’
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান বলেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা তুফান সরকারের মতো সমাজের অপশক্তি শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বাধা। এই তুফানের নেপথ্যের গডফাদারদের গ্রেপ্তার করতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ফরিদ বলেন, এই বর্বরতার নায়ক তুফান সরকার এক দিনে গড়ে ওঠেনি। এর আগেও ইয়াবা-ফেনসিডিলসহ একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিও পেয়েছে।
প্রথম আলো বগুড়া বন্ধুসভা এই মানববন্ধন ও প্রতিবাদী গণজমায়েতের আয়োজন করে। সংহতি জানিয়ে আরও বক্তব্য দেন বন্ধুসভার রকিবুল হক খান, মার্জিয়া আকতার প্রমুখ।
তুফান ও সহযোগীরা রিমান্ডে
ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় শহর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক তুফান সরকারসহ তিনজনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বিকেলে বগুড়ার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম শ্যামসুন্দর রায় এ আদেশ দেন। দুই আসামি হলেন তুফানের সহযোগী শহরের চকসূত্রাপুর কসাইপট্টির আলী আজম ওরফে ডিপু এবং কালীতলা এলাকার রূপম। অপর আসামি আতিকুর রহমান দোষ স্বীকার করে এক দিন আগেই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
তদন্ত কমিটি
জেলা প্রশাসক নূরে আলম সিদ্দিকী মা-মেয়েকে দেখতে কাল হাসপাতালে যান। তিনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেয়েটিকে চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন। তার কলেজে ভর্তির ব্যবস্থাও করবেন বলে জানান। তিনি জানান, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সামাদকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক শহীদুল ইসলাম খান ও জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম।
তদন্ত করবে আওয়ামী লীগও
ছাত্রীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয় বলে উপস্থিত নেতারা জানিয়েছেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, দলের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের সমালোচনা করে বলেন, এ ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘বগুড়ায় যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা আমাদের সহযোগী সংগঠনের ব্যাপার। তাদের ব্যাপারে আমরা যেহেতু সরাসরি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, তাই সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দ্রুত নির্দেশনা দেওয়া হবে।’
দলীয় সূত্র জানায়, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
বগুড়া জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম জানান, তুফান সরকারের কারণে কাউকে মুখ দেখানো যাচ্ছে না। কেন্দ্রের নির্দেশে তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
ঢাকায়ও প্রতিবাদ
এ ঘটনায় নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। এ ছাড়া মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু নির্যাতনের শিকার ছাত্রী ও তার মায়ের সুচিকিৎসা এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত ও সাধারণ সম্পাদক মর্জিনা খাতুনও সব অপরাধীর যথাযথ শাস্তির দাবি জানান।
No comments:
Post a Comment